অংশুমানের অপু (১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭)

52-161015105404-50

ফোনটা আসবে জানত, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আসবে, আশা করেনি অংশুমান। এত তাড়াতাড়ি ল্যান্ড করেছে ফ্লাইট? সে নিজে কোনওদিন প্লেনে কোথাও যায়নি, কিন্তু প্লেন মাটিতে নামার পর এয়ারপোর্ট থেকে বেরতেও তো কিছুটা সময় লাগে বলেই মনে হয়। সেরকম হলে তো ফোনটা এত তাড়াতাড়ি আসার কথা নয়। ইন ফ্যাক্ট প্লেন যখনই নামুক, আবার যে এই নাম্বারটা থেকে কবে ফোন আসবে, তার কোনওই নিশ্চয়তা ছিল না অংশুমানের নিজের কাছেই। তা হলে কি তারই সময়ের হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে? তিনঘণ্টা কেটে গেল এর মধ্যেই? এই নতুন জীবনটা কি একটু বেশিই তাড়াতা়ড়ি দৌড়চ্ছে?

 

সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতেই ফোনটা কেটে গেল। ফোনের ঘড়িটায় চোখ পড়ল অংশুমানের। সে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এসেছে, তিনঘণ্টাই হতে চলল বটে। তারপর প্রায় দেড়ঘণ্টা বাসজার্নি করে মেসে ফিরতে হয়েছে। এসে থেকে জামাটা জাস্ট ছেড়ে কাটা কলাগাছের মতো পড়েই ছিল খাটের উপর। এই সময়টা মেসে কেউ থাকে না। এপ্রিল মাসের অসহ্য গরমে নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে বনবন করে ঘুরে ঘরটাকে সাধ্যমতো ঠান্ডা করার চেষ্টা করছিল দু’খানা ফ্যান। গরমের জন্যই হোক আর নিজের জীবনে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া এত বড় পরিবর্তনটার জন্যই হোক, ঘুম আসছিল না কিছুতেই। অথচ এইরকম তেতো সময়গুলোয় ঘুমই হয়ে উঠতে পারে বেস্ট ফ্রেন্ড। কাল সকালে অফিস যাওয়ার আগে অবধি আর কোনও কাজ নেই। কী ভালই না হত যদি এই পুরো সময়টা চুপচাপ, স্রেফ বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা যেত!

 

আবার বাজছে ফোনটা! কী চায় মেয়েটা! যেটা চাইছে, তা না মেনে নিয়ে অংশুমানের যে অন্য কোনও উপায় নেই, তা সে নিজেও বিলক্ষণ জানে। কিন্তু অর্পিতা ঠিক যেভাবে-যেভাবে চাইবে, সেভাবেই অংশুমানকেও মানতে হবে সবকিছু? এখনও? বিরক্ত লাগে অংশুমানের। পরক্ষণেই মনে পড়ে যায়, ফোন করে কখনও অংশুমানকে না পেলে সঙ্গে-সঙ্গে কক্ষনও রিং ব্যাক করত না অর্পিতা। অথচ অর্পিতা কখনও কোনও কারণে ফোন না ধরলে একশোটা আজগুবি চিন্তায় পাগল হয়ে ক্রমাগত তাকে ফোন করতেই থাকত অংশুমান। পরে অর্পিতার কাছে বকুনি খেতে হত ঠিকই, কিন্তু তবু বারবার একই কাজ করে বসত সে। কিছুতেই আটকাতে পারত না নিজেকে। হয়তো এই পাগলামিগুলো সহ্য করতে না পেরেই সরে যেতে বাধ্য হল অর্পিতা। ওরই বা দোষ কী…

1428_6c81b1d08883e67c3f871ec9ccc5570f

দ্বিতীয়বার কেটে গেল ফোন। কাটুক। ধরবে না সে ফোন। কিছুতেই না। কথা বলতেই তো সে গিয়েছিল আজ এয়ারপোর্টে। সপ্তাহের মধ্যিখানের একটা কাজের দিনে রীতিমতো অফিস ছুটি নিয়েই তো গিয়েছিল। অর্পিতা সেটা শুনে মানা করেছে। বারবার বলেছে, ‘এভাবে পাগলামি করে কোনও লাভ নেই অংশু। কেন খামোখা অতদূরে যাবি তুই? আমি বাড়ি থেকে বাবা-মার সঙ্গে আসব। চাইলেও তোকে দশমিনিটের বেশি দিতে পারব না! কেন পাগলামি করছিস!’ অংশুমান শোনেনি। অফিসে এই ক’দিন না-চাইতেও মাঝে-মাঝেই চোখ ভিজে গিয়েছে তার। কোলিগ দাদা-দিদিরা সকলেই ওর আর অর্পিতার কথা জানত। তারা চেপে ধরেছে, ‘কী ব্যাপার?’ আর বাকিদের অল্প-অল্প গল্প বললেও সিনিয়র মোস্ট দোয়েলদিকে সব ঘটনাই খুলে বলেছে অংশুমান। দোয়েলদিও সব শুনে তাকে বলেছে, এই গল্পের এখানেই শেষ। খামোখা মায়া বাড়িয়ে আর লাভ নেই। শেষ একবার এয়ারপোর্টে গিয়ে অর্পিতার সঙ্গে দেখা করে আসার প্রস্তাবটাও অবশ্য দোয়েলদিই দিয়েছিল। নিজেই বলেছিল, ‘‘হিসেব মিটিয়ে দিয়ে আয়। আজ বুঝবি না, কিন্তু এক না একদিন নিশ্চয়ই বুঝতে পারবি, যে প্রেম শেষ হয় না, সেই প্রেমই টিকে থাকে।’’

 

আরও অনেক কথাই বলেছিল দোয়েলদি। কিন্তু সেসব ভাবার অবকাশ পেল না অংশুমান। ভাবনাটা ছিঁড়ে গেল ফোনের রিংটোনে। তৃতীয়বারের জন্য বাজছে ফোন। প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোনটা তুলে চুপ করে কানে ধরল সে।

-‘‘হ্যালো!’’

-‘‘হ্যালো অংশু! শুনতে পাচ্ছিস?’’

-‘‘হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস না? কেটে করব আর-একবার?’’

কেটে দিলে আবার ফোন করবে। অগত্যা নিজের উপস্থিতি জানান দিতেই হল অংশুমানকে, ‘‘বল।’’

-‘‘ফোন ধরছিলি না কেন? মেস ফিরিসনি এখনও?’’

-‘‘তুই পৌঁছে গিয়েছিস? এত তা়ড়াতাড়ি?’’

-‘‘তুই আগে বল, তুই ফোন ধরছিলি না কেন?’’

অংশুমান একবার ভাবল বলে দেয় যে, দোয়েলদি, ওর নিজের পাঁচবছরের রুমমেট মলয় এবং আরও অনেকেই ইতিমধ্যেই ওকে পইপই করে মানা করেছে, এয়ারপোর্টে পজ়িটিভ কিছু না হলে সেখান থেকে ফেরার পর অর্পিতার ফোন আর রিসিভ না করতে। অর্পিতাকে নিজে থেকে ফোন করা তো নৈব নৈব চ!

-‘‘কী হল! কথা শোনা যাচ্ছে না? ফোন ধরছিলি না কেন?’’

-‘‘সাইলেন্ট ছিল। শুনতে পাইনি। কোথায় তুই?’’

-‘‘মিথ্যে কথা বলিস না অংশু! তোর ফোন যে কক্ষনও সাইলেন্টে থাকে না, সেটা আর কেউ জানুক না জানুক, আমি অন্তত গত পাঁচবছর হল জানি।’’

অংশুমানের ভাল লাগছিল না পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে। তার দিক থেকে শুধু একটাই শব্দ ওপারের দিকে ছুটে গেল। ছুটে গেল না বলে অবশ্য ধীরস্থির ভাবে, হামাগুড়ি দিয়ে গেল বলাই ভাল, ‘‘হুঁ…’’

-‘‘ইচ্ছে করেই ফোনটা ধরছিলি না, বল?’’

-‘‘যদি তাই হয়, তাতে কী? এয়ারপোর্টে তো তোর কথা শুনতেই গিয়েছিলাম। তখন তো আর কিছু বললি না!’’

-‘‘কী বলতাম?’’

অংশুমান বিরক্তিটা চাপতে পারল না, ‘‘আমি জানি না। এখনই বা কী বলতে চাস? কেন ফোনটা করলি?’’

-‘‘আমি এয়ারপোর্টে কেন কিছু বলিনি, জানিস?’’

-‘‘কেন আবার! কারণ তুই ঠিক করেই নিয়েছিস এরপর কী করবি। তুই একবার যা ঠিক করিস, তা থেকে তোকে নড়ায় কার সাধ্যি, এ তো জানা কথাই।’’

-‘‘কী করব আমি এরপর?’’

-‘‘কী আবার! রবীন্দ্রনাথ তো বলেই গিয়েছেন, ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’। তোর ক্ষেত্রে আমি, আমার কেরিয়ার তোকে পিছনে টান মারছিল বারবার। সেই টানাটানিটা আর রইল না। এগিয়ে যা এবার নিশ্চিন্তে।’’

-‘‘মানে আমি এতটাই স্বার্থপর? আর তোর কোনওই দোষ ছিল না?’’

 

Airport hotels

-‘‘আমি তো বলিনি একবারও সেকথা। কিন্তু দোষ-গুণ নিয়েই তো মানুষ… যাক গে অপু, কেন এখনও এসব আলোচনা করছি আমরা?’’

‘‘করছি কারণ আমি পারিনি!’’ ওপাশের গলাটা কেমন ধরা-ধরা শোনাল এবার।

‘‘কী পারিসনি? দিব্যি তো রওনা দিয়ে দিলি। আপাতত ছ’মাস আর দেখা হওয়ার কোনও চান্স নেই। যা এবার, জি লে অপনি জ়িন্দেগি!’’ জোর করে হাসার চেষ্টা করল অংশুমান।

-‘‘তুই আসবি একবার?’’

‘‘পাগল নাকি?’’ হেসেই ফেলল অংশুমান, ‘‘আর কেনই বা যাব? কিছু সম্পর্ক সমাধি পায় অপু, সেই সমাধিতে মাঝে-মাঝে গিয়ে কিছু ফুল রেখে প্রার্থনা করে আসা যায়, একে অন্যের ভাল চাওয়া যায়। আমাদেরটা তো শ্মশানে পুড়ে ছাই হয়ে গেল অপু। ফিরে যেতে চাইলেও বা যাব কোথায়?’’

ওপাশ থেকে ভেজা গলায় উত্তর এল, ‘‘দমদম এয়ারপোর্ট…’’

-‘‘মানে! কী বলছিস! তুই… তুই কোথায়?!’’

-‘‘আমি উঠিনি প্লেনে গাধা কোথাকার! তুই চলে যাওয়ার পরও তোর ফিরে যাওয়ার মুহূর্তের মুখটা বারবার, বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ভিড় করে আসছিল পাঁচবছরের কত-কত স্মৃতি! কত-কত মুহূর্ত অংশু! আমি কোনওদিন জানতাম না আমি এত দুর্বল হয়ে পড়তে পারি! তাও আবার তোর মতো কেরিয়ার ছেড়ে নিজের স্বপ্নের পিছনে ছোটা একটা অপ… অপদার্থের জন্য! বসে থাকতে-থাকতে খেয়ালও করিনি কখন প্লেন ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমি…’’ দলাপাকানো কান্নাটাকে গিলে নিয়ে অর্পিতা আবার বলল, ‘‘আমি পারিনি যেতে অংশু। আমি বাড়িতেও জানাইনি ভয়ে। তোকেও ফোন করব কিনা বুঝতে পারছিলাম না অনেকক্ষণ! অংশু… তুই একবার আসবি প্লিজ়?’’

 

-‘‘বেরিয়ে পড়েছি অলরেডি। ওলা ডাকব বলে হেডফোনে কথা বলছি। কত নাম্বার গেটে আছিস তুই? হ্যালো? শুনতে পাচ্ছিস অপু? হ্যালো?’’

54890132

 

One thought on “অংশুমানের অপু (১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭)

Leave a comment